শনিবার, জুলাই ২৭, ২০২৪
spot_img

প্রতিবন্ধীর ভাতার টাকা হাতিয়ে দুই সমাজসেবা অফিসার বহাল তবিয়তে

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ দীর্ঘ ২৫ বছর যাবৎ মাদারীপুরে চাকুরী করে সকল প্রকার অনৈতিক কাজে তারা হয়েছেন সিদ্ধহস্ত। কখনো তাদের অপরাধ সামনে এসেছে, কেউ কেউ লিখিত অভিযোগ করেছেন প্রমাণসহ তবুও শক্ত খুঁটির জোরে বারবার নিস্তার পাচ্ছেন সকল অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকান্ড থেকে। দুই বন্ধুর প্রভাব ও দাপটে তটস্থ থাকেন জেলার অন্য সকল দপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীও। গুণধর এই দুই বন্ধু সহকারী সমাজসেবা অফিসার মোঃ শাখাওয়াত হোসেন হাওলাদার ও তাঁর সহকারী সমাজসেবা অফিসার মশিউর রহমা।

সাম্প্রতিক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভুক্তভোগী দাবী করেছেন এদের একজন এমপি কর্নেল ফারুক খানের আত্নীয় পরিচয় দিয়ে কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিভিন্ন সময়ে হুমকি ধামকি ও ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। অবৈধ অর্জনে শাখওয়াত ঢাকায় জমি কিনেছেন এবং মশিউর মাদারীপুরে বাড়ি করেছেন, ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকায় কিনেছেন ফ্লাট। ঘুষ, চুরি ও নারী এমন কোনো শাখা বাদ নেই যা নিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। মাদারীপুরে এই জুটিকে চোরে চোরে মাসতুত ভাই বলেও ডাকা হয়। সাম্প্রতিক  প্রতিবন্ধীর ভাতার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পরেও ব্যবস্থা নেয়নি সামজাসেবা অধিদপ্তর।

অভিযোগ থেকে জানা যায়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতার টাকা যাচ্ছে দুই সহকারী সমাজসেবা অফিসারের বিকাশ নম্বরে অথচ ভাতাভোগীরা জানেই না যে তাদের নামে ভাতা হয়েছে।

এই অভিনব ঘটনাটি ঘটেছে মাদরীপুর সদর উপজেলার ঘটমাঝি ইউনিয়নে। সম্প্রতি প্রাপ্ত একটি অভিযোগ থেকে জানা যায় ঘটমাঝি ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ড বাসিন্দা রূপাই হাওলাদারের নামে মাদারীপুর সদর উপজেলা হতে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে একটি প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে কিন্তু সে নিজে তা জানে না। সে অফিসে গিয়ে জানতে পারে যে তার নামের ৫ কিস্তির ১২৭৫০ টাকা এই ০১৯২৩৫৫৮২৩৭ নম্বরে পাঠানো হয়েছে এবং বিগত ২ কিস্তির ৫১০০ টাকা ০১৬৭০১৩৯১১১ এই নম্বরে ঢুকেছে এবং বর্তমানে তার নামের টাকা ০১৬৭০১৩৯১১১ এই নম্বরেই যাচ্ছে। অথচ উক্ত দু’টি নম্বরের কোনটিই তার নয়। খোঁজ নিয়ে আরো জানা যায় তার নামের সাথে বর্তমানে প্রদত্ত উক্ত বিকাশ নম্বরটি সহকারী সমাজসেবা অফিসার মোঃ শাখাওয়াত হোসেন হাওলাদার এর। তার নিজ বাড়িও ঘটমাঝি ইউনিয়নে। একই ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোঃ মামুন খান ও ছালমা বেগম দম্পত্তির বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মেয়ে ফাতেমা আক্তার এর নামে ২০২০-২১ অর্থ বছর হতে নিয়মিত ভাবে ০১৯২৮১১৩৭৩০ এই নম্বরে টাকা গেলেও হঠাৎ গত ৩ কিস্তিতে উক্ত নাম্বারে কোন টাকা আসেনি। পরে ভুক্তভোগীর মা অফিসে গিয়ে জানতে পারেন মেয়ের নামের টাকা বর্তমানে ০১৯২২১৮১২২৩ নম্বরে যাচ্ছে। উক্ত নম্বর পরিবর্তনের জন্য তারা সমাজসেবা অফিসে যায়নি বা  কোন দরখাস্ত করেনি। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায় উক্ত নম্বরটি সহকারী সমাজসেবা অফিসার শাখাওয়াত হোসেন এর এক ঘনিষ্ঠজনের।

মাদারীপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের ঘটকচর গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর সরদার অভিযোগ করেন যে অনেক আগে প্রতিবন্ধী ভাতা পাওয়ার জন্য মেম্বারের কাছে আইডি কার্ড দিয়েছিলো। জানতে পেরেছেন যে তার নামে মাদারীপুর সদর উপজেলার ঘটমাঝি ইউনিয়ন হতে ২০২২-২৩ সালে একটি প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি অফিসে গিয়ে জানতে পারেন তার নামের প্রথম ৫ কিস্তির ১২৭৫০ টাকা ০১৩৩০৯৫৩৭৪৭ এই মোবাইল নম্বরে দেওয়া হয়েছে এবং বিগত ২ কিস্তির ৫১০০ টাকা ০১৭১৫১৯৯৫৯৪ এই নম্বরে ঢুকেছে এবং বর্তমানে তার নামের টাকা ০১৭১৫১৯৯৫৯৪ এই বিকাশ নম্বরেই যাচ্ছে। কিন্ত উক্ত দুটি নম্বরের কোনটিই মিজানুর সরদারের নয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায় উক্ত বিকাশ নম্বরটির মালিক মোঃ মশিউর রহমান যে কালকিনি উপজেলার সহকারী সমাজসেবা অফিসার হিসেবে কর্মরত। এদিকে কালকিনি সমাজসেবা কার্যালয় থেকে জানা যায় কালকিনি পৌরসভার ৫ ওয়ার্ডের বাসিন্দা জনৈক মনোয়ারা বেগমের নামের বয়স্ক ভাতার টাকাও যায় ০১৭১৫১৯৯৫৯৪ নম্বরে। মশিউর রহমান শাখাওয়াত হোসেন হাওলাদার এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

তারা দুইজন ১৯৯৮ সালে ফিল্ড সুপারভাইজার হিসেবে সমাজসেবা অধিদফতরে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকেই তারা ঘুরেফিরে মাদারীপুরের বিভিন্ন উপজেলাতেই কর্মরত আছেন। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তার একই সাথে পদোন্নতি পেয়ে ফিল্ড সুপারভাইজার হতে সহকারী সমাজসেবা অফিসার হিসেবে বিধি বহির্ভূতভাবে পূর্ববর্তী কার্যালয়েই পদায়ন পেয়েছেন।

সরকারী চাকুরীজীবীদের নির্দিষ্ট সময় পরপর বদলির বিধান থাকলেও উক্ত ২ ব্যক্তি প্রায় ২৫ বছর যাবৎ সদরসহ মাদারীপুরেরই বিভিন্ন কার্যালয়ে চাকরি করার সুবাদে এবং মাদারীপুরের স্থানীয় হওয়ার সুবাদে কতিপয় অসাধু কর্মচারীদের কে নিয়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন যাদের সহযোগিতা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কাজ ও অপকর্ম করে থাকেন।

অভিযোগ থেকে আরো জানা যায় মাদারীপুর সদর উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে কর্মরত সকল কর্মকর্তা কর্মচারীদের বাড়িও মাদারীপুর সদরে এবং তারা দীর্ঘদিন একই এলাকায় চাকরি করার কারনে নিজেদের মধ্যে এক ধরনের বেপরোয়া ভাব নিয়ে চলেন। কেউ কোন নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করেন না।

সহকারী সমাজসেবা অফিসার শাখাওয়াত হোসেন সমাজসেবা অধিদফতরের (রেজিস্ট্রেশন রেজি: মাদা-৩৮৪ তাং০৮/০২/২০১২)নিয়ে ‘ভদ্রখোলা আদর্শ সংস্থা’ নামে একটি ভূয়া স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে প্রতিবছর সমাজকল্যাণ পরিষদ থেকে ৩০/৪০ হাজার টাকা অনুদান যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ৪০/৫০ হাজার টাকা অনুদান সহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিত কোন সংগঠন বা সংস্থার পদে থাকার নিয়ম না থাকলেও সে শুরু থেকেই উক্ত সংস্থার সভাপতি হিসেবে আছেন। এছাড়াও তার এক ভাগিনা এসপি আরেক ভাগিনা হিসাব রক্ষন বিভাগে বড় পদে চাকরি করে এসব বলে কর্মচারীদের মধ্যে একটি ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে যাতে কর্মচারীরা কেউ তার মতের বিরুদ্ধে না যায়। সে এবং তার পরিবার এলাকায় খুবই ভয়ংকর পরিবার হিসেবে পরিচিত। তারা সকলেই মার্ডার মামলার আসামি ছিলো। তার বাবা ছিলেন একজন তালিকাভুক্ত রাজাকার।

অন্যদিকে তার বন্ধু সহকারী সমাজসেবা অফিসার মশিউর রহমান নিজেকে গোপালগঞ্জ ০১ আসনের এমপি কর্নেল ফারুক খানের আত্নীয় পরিচয় দিয়ে কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিভিন্ন সময়ে হুমকি ধামকি ও ভয়ভীতি দেখায়। অনুসন্ধানে জানা যায় দীর্ঘদিন একই এলাকায় চাকরি করার কারনে নিজের প্রভাব খাটিয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তর সহ বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। অবৈধ টাকায় শাখওয়াত ঢাকায় জমি কিনেছেন এবং মশিউর মাদারীপুরে বাড়ি করেছেন, ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকায় কিনেছেন ফ্লাট।

অভিযোগ রয়েছে যে এই দুই সহকারী সমাজসেবা অফিসার ও তাদের সহযোগীরা কোন কাজ কর্ম করে না। অফিসারদের কোন কথা শুনে না। ঠিকমত অফিস করে না। কর্মকর্তাদের অনুমতি ছাড়াই অফিস থেকে চলে যায়। প্রায়দিনই জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে গিয়ে বসে থাকে আর বিভিন্ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তাদের যন্ত্রণায় কোন অফিসার এখানে ঠিকমত কাজ করতে পারে না।

এ ব্যাপারে জেলার উপ-পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি শুনেছেন বলে জানান।  তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নীতে তিনি অপারগ বলেও নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন। অভিযোগের ব্যাপারে দুই সহকারী সমাজসেবা অফিসারের সাথে যোগাযোগ করার জন্য একাধিকবার ফোন করলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।

আরো দেখুন
Advertisment
বিজ্ঞাপন

সবচেয়ে জনপ্রিয়