বৃহস্পতিবার, মে ৯, ২০২৪
spot_img

বন্দরে ইট ভাটার হুমকিতে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ নারায়নগঞ্জ বন্দর উপজেলায় অবস্থিত সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে চলছে ইট ভাটা। অধিকাংশ ভাটা পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশপাশে ও ফসলি জমিতে স্থাপন করা হয়েছে। ইট ভাটায় প্রকাশ্যে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে পরিবেশ ও প্রতিবেশী। আইন অমান্য করে দিনের পর দিন ইট ভাটার সংখ্যা বাড়লেও প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

নারায়নগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বন্দর উপজেলায় মোট ইট ভাটার সংখ্যা ৫০টি। তবে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রের তথ্য বলছে, জেলায় ইট ভাটার সংখ্যা ৭৫টি। ১০বছর আগেও জেলায় ইট ভাটা ছিল ৩০ থেকে ৪০টি। এদিকে, ভাটায় উন্নত প্রযুক্তির জিগজ্যাগ কিলন, ভার্টিক্যাল স্যাফট ব্রিককিলন, হাইব্রিড হফম্যান কিলন ও টানেল কিলন ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও ৩৫টি ভাটাতেই ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ ব্যারেল চিমনি।

সরজমিনে ইট ভাটাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব ইট ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষি জমির মাটি। ফলে একদিকে নির্বিচারে উজাড় হচ্ছে বন, অন্যদিকে উর্বরতা হারিয়ে চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে জমি।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, আকারভেদে একটি ইট ভাটা গড়তে কমপক্ষে পাঁচ একর (৫০০ শতাংশ) জমি প্রয়োজন। তবে ক্ষেত্রবিশেষে ৪৫ থেকে ৫০ একর জমিরও প্রয়োজন হয়। আর এসব ইট ভাটা গড়ে উঠার কারণে চার থেকে পাঁচ শতাধিক একর ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ইট ভাটার ম্যানেজার জানালেন, সাধারণত মধ্যম সারির একটি ভাটায় বছরে ৪০ থেকে ৫০ লাখ ইট পোড়ানো হয়। আর প্রতি আট হাজার ইটের জন্য কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার হয় এক হাজার ঘনফুট মাটি। সেই মাটির জোগান আসে কৃষি জমি থেকে। এজন্য প্রতিটি ভাটায় বছরে পাঁচ থেকে ছয় একর জমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহার করা হয়। সে হিসাবে ৭০টি ভাটাতে প্রতি বছর অন্তত সাড়ে ৩০০ একর জমির মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক মালিক জানান, ইট পোড়ানোর জন্য প্রতিটি ভাটায় দৈনিক গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ মণ কাঠ পোড়াতে হয়। সে হিসাবে জেলার ৭০টি ইটভাটায় প্রতিদিন ২ হাজার ৪৫০ মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। কাঠ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে, বিভিন্ন গ্রাম থেকে সংগৃহীত কাঠ এসব ভাটায় জোগান দেওয়া হয়। গড়ে প্রতিটি গাছ থেকে সাত থেকে আট মণ কাঠ পাওয়া যায়।
এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিন উপজেলার বিভিন্ন ইট ভাটায় আম, জাম, কদম, কাঁঠাল, খেজুর, নারকেল গাছ সহ তিন শতাধিক ফলজ ও বনজ গাছ পোড়ানো হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭-এর ৭ ধারা অনুযায়ী কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানোকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।

এ আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে প্রথমবার সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা এবং দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে ১ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ও সাজার বিধান রাখা হয়েছে। তৃতীয়বার এ অপরাধের পুনরাবৃত্তিতে ভাটার নিবন্ধন বাতিল ও ভাটা বাজেয়াপ্ত করারও বিধান রাখা হয়েছে। কাগজে-কলমে এসব আইন বাস্তবায়নে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই!

এদিকে, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩-তে বলা হয়েছে— কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, হাট-বাজার এলাকা, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর এবং বন অভয়ারণ্য, বাগান, জলাভূমি ও কৃষি জমিতে ইট ভাটা স্থাপন করা যাবে না। তবে আইনের তোয়াক্কা না করেই বন্দর উপজেলার অধিকাংশ ইট ভাটা স্থাপন করা হয়েছে ঘনবসতিপূর্ণ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন ফসলি জমিতে। এমনকি মদনপুর কেওঢালা নাগিনা জোহা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্রের সামনেই মেসার্স টাটা ব্রিকস, খান ব্রিকস, বি,আর,বি, এস কে বি, বি,বি,সি,এন,বি,এন,এ,বি,সি এবং আনন্দ, মেসার্স আল্লাহর দান(এডিসি), সেভেন জিরো সেভেন ইট ভাটা। অধিকাংশ ইট ভাটার লাইসেন্স এবং পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ও নবায়ন নেই।

ইট ভাটার ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষণ ছাড়াও স্থানীয়রা নানা ধরনের সমস্যার কথা জানাচ্ছেন। উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়ন দাসেরগাও গ্রামের কৃষক আমিন,শওকত সহ স্থানীয় কয়েকজন কৃষক বলেন, ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষেতের পাশে ইট ভাটা গড়ে ওঠায় আগের তুলনায় উৎপাদন কমে গেছে। সরকার ফসলি জমির ওপর ইট ভাটা স্থাপন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পাঁচ বছরের মধ্যে এসব জমির উৎপাদন শূন্যে নেমে আসবে।

স্থানীয়রা আরও বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের মধ্যে শ্বসনতন্ত্রের রোগব্যধিতে আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণ বেড়েছে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে অসুস্থতা বেড়েছে।
বন্দর উপজেলা হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান ইট ভাটার প্রভাবে স্থানীয়দের মধ্যে অসুস্থতায় আক্রান্তের আশঙ্কার কথা জানান। তিনি বলেন, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যদি কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হয়, তাহলে এর বিষাক্ত ধোঁয়ায় ব্রংকাইটিস, শ্বাসকষ্টসহ শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের প্রকোপ স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়। ফলে এ বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে।

স্থানীয় পরিবেশের ওপর ইট ভাটার প্রভাব নিয়ে আশঙ্কার কথা তুলে ধরে পরিবেশ অধিকারকর্মী এডভোকেট মোকাদ্দেস হোসেন বলেন, আমরা দেখেছি—প্রতিটি ভাটায় কয়লার পরিবর্তে জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। কৃষি জমি এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতেও গড়ে ওঠা এসব ভাটায় স্বল্প উচ্চতার টিনের তৈরি চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। এতে ফসলসহ পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এরকম চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এই এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশের বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে।
ইট ভাটার জ্বালানি হিসেবে কয়লার পরিবর্তে কাঠ পোড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে অধিকাংশ ভাটার মালিক বলেন, চাহিদার তুলনায় কয়লার সরবরাহ কম দাম বেশি। তাই কয়লা দিয়ে ইট পোড়ালে তাদের লভ্যাংশ কমে যায়। ফলে লাভ বাড়াতেই তারা কাঠ পুড়িয়ে থাকেন। সরকার পর্যাপ্ত পরিমাণ কয়লা আমদানির মাধ্যমে সাশ্রয়ী দামে সরবরাহ করতে পারলে তবেই ইট ভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধ করা যাবে বলে মনে করছেন তারা।

কৃষিতে ইট ভাটার প্রভাব নিয়ে জানতে চাইলে বন্দর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন অফিসার তানিয়া সুলতানা বলেন, কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি কাটা হলে এর উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়। চার-পাঁচ বছরের ব্যবধানে জমিতে ফসল উৎপাদন ব্যাপক হারে কমে যায়। ফসলি জমির মাটি কেটে ভাটায় ব্যবহার বন্ধে ও ফসলি জমির পাশে ইটভাটা স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য আমরা জেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে অনুরোধ জানাব।

ইট ভাটাগুলোর অনিয়ম নিয়ে জানতে চাইলে নারায়নগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, ইট ভাটা পরিচালনায় নীতিমালার ব্যত্যয় হলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। আমাদের জেলায় তিন থেকে চারশত ইটভাটা রয়েছে। আমরা ইট ভাটা মালিক সমিতির সঙ্গে কথা বলেছি। যত খরচই হোক না কেন, তাদের আইন মেনেই ভাটা পরিচালনা করতে হবে। তা না করতে পারলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আইন অমান্য করে কাঠ পোড়ানো, বসতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশেই ভাটা পরিচালনা করা— চলে আসা এসব অনিয়ম বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জেলা প্রশাসক আইন আমান্য করে গড়ে ওঠা ইট ভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।

আরো দেখুন
Advertisment
বিজ্ঞাপন

সবচেয়ে জনপ্রিয়