শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
spot_img

রাজ্যের সব অসহায়ত্ব মায়ের মুখ, বাবার সাথে আর হবেনা খুনসুট

সংবাদ ডেস্কঃ রোববার (৫ সার্চ) সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে সায়েন্সল্যাবের একটি ভবনের তৃতীয় তলায় অবস্থিত ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অফিসে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে পাশের একটি ১৪ তলা আবাসিক ভবনও কেঁপে ওঠে।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ওই ঘটনায় পপুলার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। ময়নাতদন্তের জন্য তাদের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। তাদেরকে পপুলার হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) এবং শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। পাঁচজনের অবস্থা গুরুতর।

১* মেয়ের সঙ্গে সকালে এক দফা খুনসুটি হয়েছে বাবা শফিকুজ্জামানের (৪৫)। অনেক বুঝিয়ে সকাল সোয়া ৮টায় বাসা থেকে কর্মস্থল নিউ জেনারেশন লিমিটেডের উদ্দেশ্যে বের হন। এ যাত্রাই যে তার শেষ যাত্রা ছিল কে জানত। কর্মস্থলে আকস্মিক বিস্ফোরণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় শফিকুজ্জামানের শরীর।

গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু তাকে আর বাঁচানো যায়নি। সায়েন্সল্যাবের বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনিসহ মোট তিনজন পাড়ি জমান পরপারে।

স্বামী কর্মস্থলে পৌঁছাতে পেরেছেন কি না—জানতে ফোন করেন স্ত্রী পপি। কিন্তু ফোন বন্ধ। একটু পর কর্মস্থলের এক সহকর্মী ফোন করে পপুলার হাসপাতালে আসতে বলেন। জানান, অসুস্থ শফিকুজ্জামান।

ছেলে-মেয়েকে ঘরে রেখেই পপুলার হাসপাতালে ছুটে আসেন পপি। স্বামীর ক্ষতবিক্ষত মরদেহ দেখে নির্বাক হয়ে পড়েন তিনি।

রোববার (৫ মার্চ) সন্ধ্যায় পপুলার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন শফিকুজ্জামানের স্ত্রী পপি আক্তার। রাজ্যের সব অসহায়ত্ব যেন ভর করেছে তার মুখে। পাশেই বসা বোন পাপিয়া খানসহ আত্মীয়-স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে দেখা যায় পপিকে।

বোন পাপিয়া বলেন, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাদের সুখের সংসার ছিল। ছেলে আরিফুজ্জামান সপ্তম শ্রেণিতে, মেয়ে তৈয়বার বয়স মাত্র তিন বছর। ‘কী বলব, এভাবে ভাইটা চলে যাবে ভাবতেই পারছি না। দুটো ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যত কী হবে, কে দেখবে তাদের।

ওর সন্তানরা জানে বাবা অসুস্থ। স্বামীর মরদেহ দেখার পর পপি কোনো কথা বলছে না, কান্নাও করছে না। নির্বাক, স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। পাপিয়ার অনুরোধ, কর্মস্থলের মালিক এবং প্রধানমন্ত্রী যেন নির্মম এ দুর্ঘটনার প্রতি বিশেষ নজর দেন। ক্ষতিগ্রস্ত সব পরিবারকে যেন পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন।

২* একই ঘটনায় নিহত হন নিউ জেনারেশন লিমিটেডের মার্কেটিং ম্যানেজার আব্দুল মান্নান (৬৫)। তার মরদেহ নিতে পপুলার হাসপাতালে অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায় বড় ভাই ও বোনসহ সন্তানদের। জানা যায়, নিহত আব্দুল মান্নানের বাড়ি রাজধানীর লালবাগে। তিনি গত ২৫ বছর ধরে সেখানে চাকরি করে আসছিলেন।

বড় ভাই আব্দুল করিম বলেন, গাজীপুরে ছিলাম। সকালেও ছোট ভাইটার সঙ্গে কথা হয়েছে। ১১টার দিকে খবর পাই বিস্ফোরণের। হাসপাতালে এসে দেখি ভাই আমার মারা গেছে।

আক্ষেপ করে তিনি বলেন, মান্নানের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। আদরের মেয়েটা অসুস্থ ছিল। গত মাসে (৪ ফেব্রুয়ারি) মারা গেছে। সেই শোকে কাতর ছিল মান্নান। আজ সেও চলে গেল।

বড় বোন রাবেয়া আক্তার বলেন, ২৫ বছর ধরে একই অফিসে কাজ করছে মান্নান। কতটা ভালো মানুষ হলে একই অফিসে এতদিন কাজ করা যায়। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বড় ছেলে আসিফ বলেন, এক মাস আগে বোনকে হারিয়েছি, আজ বাবাকে। মাকে কীভাবে সান্ত্বনা দেব, ভেবে কূল পাচ্ছি না। কীভাবে বাবার নিথর দেহটা মায়ের সামনে নেব।

৩* একই প্রতিষ্ঠানে (নিউ জেনারেশন লি.) মার্কেটিং বিভাগে কাজ করতেন নিহত সাদিকুর রহমান তুষার (৩৫)। বাড়ি নরসিংদীর বেলাবোতে। স্ত্রী জেরিন ও চার বছরের শিশুকন্যা থাকে গ্রামের বাড়িতে।

পপুলার হাসপাতালে নিহত তুষারের বড় ভাই শফিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সকাল সাড়ে ১১টার দিকে স্ত্রী জেরিনের নম্বরে কল আসে তুষারের নম্বর থেকে। জানানো হয়, ফোনটা ঘটনাস্থলে পড়ে ছিল, কিন্তু ফোনের মালিককে পাওয়া যাচ্ছে না। খবর পেয়ে ছুটে আসি হাসপাতালে। এসে শুনি ভাই আমার নাই।

ওর ঘরে স্ত্রী আর চার বছরের মেয়ে। তুষার ছাড়া পরিবারটি কীভাবে চলবে, ভাবতে পারেন? সবকিছু দুঃস্বপ্ন লাগছে। এটা নিছক দুর্ঘটনা বা এসি বিস্ফোরণ থেকে ঘটতে পারে না— দাবি করে শফিকুর রহমান বলেন, আমি নিজেও একটি এসি কোম্পানিতে চাকরি করি। এসির বিস্ফোরণ কখনও এত বড় হতে পারে না। এটা অন্যকিছু।

নিউ জেনারেশন লিমিটেডের মালিক আকরাম হোসেন জানান, তার প্রতিষ্ঠান স্কুল স্টেশনারি সামগ্রী বিক্রি করে। ৩৫ বছরের ব্যবসা। কখনও এত বড় শক (অভিঘাত) খেতে হয়নি। অফিসে সাতজন কর্মী ছিলেন। ঘটনার সময় পাঁচজন উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে তিনজনই নেই।

বিস্ফোরণের ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়, দাবি করে তিনি বলেন, ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্সের অফিস থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত হয়। সেখানে কেন বিস্ফোরণ ঘটল, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা দরকার। পাশাপাশি নিচেই ভবন-লাগোয়া একটি ট্রান্সফরমার ছিল। সেটি থেকেও আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।

জানা গেছে, পপুলার হাসপাতালে মারা যাওয়া তিনজন হলেন, নিউ জেনারেশন লিমিটেডের কম্পিউটার অপারেটর শফিকুজ্জামান (৪৫), একই প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং ম্যানেজার ও লালবাগের বাসিন্দা আব্দুল মান্নান (৬৫) এবং মার্কেটিং বিভাগের কর্মকর্তা সাদিকুর রহমান তুষার (৩৫)। তুষারের বাড়ি নরসিংদীতে।

আরো দেখুন
Advertisment
বিজ্ঞাপন

সবচেয়ে জনপ্রিয়