শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪
spot_img

মিরপুর টু আশুলিয়া বেড়িবাঁধ যেন চোরাই তেলের অভয়ারণ্য

মো.মাইনুল ইসলাম, সাভার ঢাকাঃ ঢাকার রাজধানীর উপকণ্ঠে চার থানার সীমানা মিলে মিরপুর বেড়িবাঁধ। বন্যার কবল থেকে রাজধানীবাসীকে বাঁচাতে তুরাগ নদ শাসনে গড়ে তোলা এ বেরিবাঁধ একসময় ছিল ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্য। মাঝেমধ্যেই অপরাধীরা এ বাঁধের দুই পাড়ে লাশ ফেলে রেখে যেত। বেরিবাঁধের ঢালে ও খালের ওপর ছিল অপরাধমূলক কার্যকলাপের বিভিন্ন আস্তানাও। আগের চেয়ে এসব অপরাধ কিছুটা কমলেও বর্তমানে এ বাঁধ যেন হয়ে উঠেছে চোরাই তেলের হাট। ভেরিবাঁধের ওপর ঢাকা থেকে টঙ্গীমুখী সড়কের দুই পাশে গড়ে উঠেছে সরকারি-বেসরকারি যানবাহনের চুরি করা অবৈধভাবে তেল কেনার বেশ কিছু অবৈধ স্থাপনা।

চোরাই তেলের এসব কারবারি বিক্রেতা গাড়িচালকদের একদিকে তেলের দাম যেমন কম দেন, অন্যদিকে বেশি তেল নিয়ে মাপেও কম ধরেন। এভাবে চোরাই তেল কারবারিরা দুদিক থেকেই লাভ করে পকেট ভারী করছেন। আর চোরাই এ তেল কারবারিদের কাছ থেকে প্রতি রাতে ব্যারেল ব্যারেল নিয়ে যান সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা। তারা স্থানীয় খোলাবাজারে এ তেল সরবরাহ করে থাকেন। গত কয়েক দিন ধরে সাভার, আশুলিয়া, রূপনগর ও শাহ আলী থানাধীন বেড়িবাঁধ এলাকা ঘুরে অন্তত ডজন খানেক তেল চুরির অবৈধ স্থাপনা দেখা গেছে।

রাস্তার পাশে কোথাও কালো কাপড় দিয়ে আড়াল করে আবার কোথাও টিনের বেড়া দিয়ে চোরাই তেল কেনার স্থাপনা গড়ে তুলেছে স্থানীয় বেশ কয়েকটি চক্র। এসব অবৈধ স্থাপনায় দিনের বেলায় তেমন কোনো গাড়ি চোখে না পড়লেও সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই ভিড় জমে বিভিন্ন যানবাহনের। যার মধ্যে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি ডাম্প ট্রাক, লরি, কাভার্ড ভ্যান, প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস। এসব যানবাহনের চালক চোরাই তেল কেনার স্থাপনার সামনে গাড়ি থামিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে জ্বালানি তেলের ট্যাংক থেকে তেল বের করে বিক্রি করে দেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের রূপনগর ও শাহ আলী থানা পুলিশের সহায়তায় চোরাই তেল কারবারিরা অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ করেছেন বেড়িবাঁধের আশপাশের লোকালয়ের বাসিন্দারা। এছাড়া বেরিবাঁধের কিছু অংশ সাভার, আশুলিয়া ও তুরাগ থানার মধ্যে পড়েছে।

সাভারের বিরুলিয়া ব্রিজসংলগ্ন বেড়িবাঁধ থেকে রূপনগর এবং শাহ আলী থানাধীন বেড়িবাঁধ ঘুরে দেখা গেছে, কিছুদূর পরপরই তেল রাখার গ্যালন, ড্রাম, প্লাস্টিকের পাইপ ও বালতি নিয়ে বসে আছেন অবৈধ চোরাই তেল কারবারিরা। বাঁধের ওপরই কোথাও প্লাস্টিকের কাগজ, কোথাও কালো কাপড় আবার কোথাও বা ভাঙা টিনের বেড়া দিয়ে ছোট ছোট টং ঘর বা দোকান তৈরি করা এসব কর্মকাণ্ড করে থাকেন। এসব স্থাপনার সামনে যানবাহন পার্কিংয়ের জায়গা রাখা হয়েছে। বেরিবাঁধের সড়ক দিয়ে চলতে চলতেই বিভিন্ন যানবাহনকে সেসব স্থাপনায় ঢুকতে দেখা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চোরাই তেল কারবারি জানিয়েছেন, চালকদের কাছ থেকে প্রতি লিটার অকটেন তারা কেনেন ১১৫ টাকায় আর ডিজেল বা পেট্রোল কেনেন ১১০ টাকা করে। পরে সেই তেল গাজীপুর, ঢাকা, আশুলিয়া ও সাভারের বিভিন্ন এলাকার তেল ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, দিনের বেলায় তেল কারবারিরা অলস বসে থাকেন। মাঝেমধ্যে দুয়েকটি গাড়ি থেকে তেল কিনতে পারেন। তবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই স্থাপনা গুলোতে কেউ হারিকেন জ্বালিয়ে,কেউবা আবার কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে রাখেন। গাড়ির চালক তেল বিক্রির উদ্দেশ্যে স্থাপনায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির সব লাইট বন্ধ করে দেন। তারপর হ্যারিকেন বা কুপির আলোতেই ট্যাংকিতে পাইপ লাগিয়ে বিশেষ কৌশলে তেল টেনে বের করে নেন কারবারিরা। অনেক সময় পাইপে মুখ লাগিয়ে বাতাস টেনে তেল বের করে নেন কর্মচারীরা। এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় মাপে কম দেখান কারবারিরা। বেড়িবাঁধ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মিরপুর গুদারাঘাট এলাকাতেই রয়েছে তিনটি তেল কেনার স্থাপনা। বিরুলিয়া হাউজিং এলাকাসংলগ্ন বেড়িবাঁধে আছে দুটি স্থাপনা। এছাড়া সাদি পেট্রোল পাম্পসংলগ্ন বেড়িবাঁধ এলাকায় আছে আরও দুটি। এ ছাড়া গাবতলী থেকে আশুলিয়ার দিকে যেতে যেতে মাঝেমধ্যেই অনেক স্থাপনা আমাদের চোখে পড়েন।

চোরের ওপর বাটপারিঃ তেল বিক্রেতা একাধিক চালক ও স্থানীয়রা জানান, অবৈধ তেল কারবারিরা তেলের দামে যেমন কম দেন, তেমনি বেশি তেল নিয়ে মাপেও কম ধরেন। ট্যাংকি থেকে সাত লিটার নিয়ে ধরে পাঁচ লিটার, আবার দেড় লিটার টেনে নিয়ে দাম দেন মাত্র এক লিটারের। এভাবে চোরাই তেল কারবারিরা দুদিক থেকেই লাভবান হন। এসব তেল কারবারির কাছ থেকে প্রতি রাতে ব্যারেল ব্যারেল তেল কিনে নিয়ে যান আশপাশের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তারা সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকার খোলাবাজারে এ তেল সরবরাহ করে থাকেন।

বেড়িবাঁধে তেল বিক্রি করতে আসা একটি কাভার্ড ভ্যানের (রেজিস্ট্রেশন নম্বরঃ ঢাকা-মেট্রো-গ-৫৪৬২৩৩) চালক এ প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, চুক্তিতে ভাড়া মারার পর যে তেল বাঁচে সেটাই তিনি বিক্রি করেন। কারও তেল চুরি করে বিক্রি করেন না। উল্টো তিনি তেল কারবারদের চোর আখ্যা দিয়ে বলেন,ওরা পাইপ দিয়ে ট্যাংকি থেকে এক টানেই পাঁচ লিটার বের করে নিয়ে যায়। দাম দেয় মাত্র তিন লিটারের। এখন বলেন চোর কে?

তেল বিক্রি করতে আসা এ চালকের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চোরাই তেল কারবারি মান্নান বলেন, ‘রাইতের কামে একটু এদিক-সেদিক হইবোই। যার দরকার সেই বিক্রি করে। আমরা তো জোর করে নেই না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইস্টার্ন হাউজিংসংলগ্ন বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে পঞ্চবটী পর্যন্ত বেড়িবাঁধ পড়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রূপনগর থানা এলাকায়। তামান্না পার্কের সামনে থেকে দিয়াবাড়ী পর্যন্ত বেড়িবাঁধ এলাকাটি পড়েছে শাহ আলী থানা এলাকায়। বিরুলিয়া ব্রিজ সংলগ্ন বেড়িবাঁধের একপাশ পড়েছে সাভার থানায়। বিপরীত পাশের প্রিয়াঙ্কা শ্যুটিং স্পট এলাকা পড়েছে রূপনগর থানায়। আর ধউর থেকে কামারপাড়া পর্যন্ত তুরাগ থানায়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, চোরাই তেল কেনাবেচার অবৈধ স্থাপনা থেকে সবচেয়ে বেশি তেল কিনে নিয়ে যান সাভার ও আশুলিয়ার একাধিক অবৈধ তেল কারবারিরা। তারা চোরাই তেলের অধিকাংশই সররাহ করে থাকেন খোলাবাজারে। এমনকি মুদির দোকানেও খুচরা বিক্রির জন্য সরবরাহ করা হয় এসব ডিজেল, অকটেন ও পেট্রোল। বিভিন্ন এলাকা থেকে ভ্যান নিয়ে এসে এ তেল নিয়ে যান তারা। সাভারের বিরুলিয়া, আশুলিয়ার আনারকলি ও কলমার গ্রামের বেশিরভাগ খোলাবাজারের তেল এসব কারবারির কাছ থেকে কেনা হয়ে থাকে।

চোরাই তেল পরিবহনের এমনই একজন ভ্যানচালক সোহরাব মিয়া। আমাদের জানান, তার একাধিক ভ্যান আছে এ তেল বহনের জন্য। প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে তিনি তার ভ্যান নিয়ে বিরুলিয়ার বাসিন্দা সাজির কাছ থেকে তেল সংগ্রহ করেন। সেই তেল নিয়ে আশুলিয়া ও সাভারের বিভিন্ন দোকানদারের কাছে দিয়ে আসেন। তামান্না পার্কসংলগ্ন তেল কেনার স্থাপনার মালিক সানি। তিনি দোকানে থাকেন না। কর্মচারী দিয়ে চালকদের কাছ থেকে তেল কিনে থাকেন। সরবরাহ করেন আশপাশের বিভিন্ন এলাকায়। তেল কেনার আরেকটি স্থাপনার মালিকও সানি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিরুলিয়ার এক বাসিন্দা আমাদের জানান, একসময় অপরাধীরা বেড়িবাঁধে মানুষের লাশ ফেলে যেত। সেটা বন্ধ হওয়ার পর অসামাজিক কার্যকলাপের নানা ধরনের আস্তানা গড়ে তুলেছিল একশ্রেণির ব্যবসায়ী। সেটাও এখন আর দেখা যায় না। কিন্তু এখন এ বেরিবাঁধ ঘিরে গড়ে উঠেছে চোরাই তেল কেনাবেচার সিন্ডিকেট। যারা প্রতি রাতে এসব দোকান থেকে ব্যারেল ব্যারেল চোরাই তেল কম দামে কিনে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে থাকে। অনেক সময় এ তেলে ভেজালও থাকে। এসব তেল কারবারির অধিকাংশই নিজেদের লোকজন দিয়ে সরাসরি খোলাবাজারে সরবরাহ করে থাকে।’

যেসব গাড়ির চালক বিক্রি করেন তেল : সিটি করপোরেশনের বড় বড় ডাম্প ট্রাক,সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে নিয়োজিত বড় বড় ট্রাক ও লরির চালকরা বেড়িবাঁধের স্থাপনাগুলোতে গিয়ে ট্যাংকি থেকে তেল বিক্রি করে দেন। সারা রাতই এসব স্থাপনা সচল থাকে। সরকারি গাড়ির চালকরা তাই রাতের আঁধারে বেড়িবাঁধের এসব স্থাপনায় গিয়ে তেল বিক্রি করে আসেন।

এলাকাবাসী জানায়, গত চার বছর ধরে এ তেল কারবারিরা বাঁধের দুই পাশে এসব অবৈধ স্থাপনা বসিয়ে তেল কিনছেন। প্রথমদিকে দুয়েকজন এ কাজে জড়িত ছিলেন। লাভ বেশি হওয়ায় চোরাই তেল কারবারির সংখ্যাও দিনে দিনে বেড়ে চলেছে।

বেড়িবাঁধে দায়িত্ব পালনকারী একাধিক ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা আমাদের এই প্রতিবাদকে জানিয়েছেন, তাদের চোখের সামনে এ কারবার চললেও করার কিছু নেই। কারণ এসব স্থাপনা মালিকরা সরাসরি থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে কারবার চালাচ্ছেন। তাদের কেউ কেউ দৈনিক আবার কেউ কেউ মাসে মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিয়ে কারবার করে যাচ্ছেন। একই ধরনের তথ্য দিয়েছেন রূপনগর, শাহ আলী ও বিরুলিয়া এলাকার ভ্যান, রিকশা ও বাস চালকরাও।

তারা জানান, সবকটি স্থাপনার জন্যই স্থানীয় পুলিশকে মাসোহারা দিতে হয়। খোলা দোকান থেকে মোটরসাইকেল চালকরা এসব চোরাই তেল কিনে থাকেন। এ ছাড়া বিভিন্ন বাসাবাড়ির জেনারেটর মালিকরা কিনে থাকেন। যেসব এলাকায় পাম্প নেই, সেসব এলাকার খোলা দোকানে এসব চোরাই তেল বেশি বিক্রি হয়। অনেক মুদি দোকানেও বিক্রি হয় এসব চোরাই তেল।

বেড়িবাঁধে চোরাই তেলের কারবারের বিষয়ে জানতে চাইলে রূপনগর থানার ওসি বলেন,এ বাঁধে অনেক আগে চোরাই তেল কেনাবেচার আস্তানা ছিল। সেগুলো আমরা উঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন নতুন করে যদি কেউ এ ধরনের অবৈধ আস্তানা তৈরি করে তেল কেনাবেচা করে থাকে, তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পুলিশের বিরুদ্ধে মাসোহারা নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন,থানা পুলিশকে জানিয়ে কখনো কি কেউ অবৈধ কাজ করতে পারে? এটা কখনোই হতে পারে না। বেরিবাঁধের সীমানা অনেক থানা এলাকায় পড়েছে। সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের পাশাপাশি এগুলো উচ্ছেদের দায়িত্ব কিন্তু ট্রাফিক পুলিশের ওপরও বর্তায়।

আরো দেখুন
Advertisment
বিজ্ঞাপন

সবচেয়ে জনপ্রিয়