বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৩, ২০২৪

ভাষা আন্দোলনকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রথম পদক্ষেপ মনে করা হয়

সংবাদ ডেস্কঃ প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দুই ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে সূচনা হয়েছিল আন্দোলনের। এই ভাষা আন্দোলনকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মনে করা হয়।

১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হতো। এই ইতিহাস বাংলাদেশের অনেকেরই জানা। কিন্তু এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরির পেছনে রয়েছে আরও অনেক সংগ্রামের ইতিহাস।

ভাষা থেকে যেভাবে আন্দোলনের সূচনা:
১৯৪৭ সালে যখন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছিল তার আগেই আসলে শুরু হয়েছিল ভাষা নিয়ে বিতর্ক। ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক তাদের ভাষা আন্দোলন-ইতিহাস ও তাৎপর্য বইয়ে লিখেছেন, “প্রথম লড়াইটা প্রধানত ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ”।

এই বইটির বর্ণনা অনুযায়ী দেশভাগের আগেই চল্লিশের দশকের শুরুতেই সাহিত্যিকরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। সেসময় বাঙালী মুসলমান সাহিত্যিক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদদের মধ্যে বাংলা, উর্দু, আরবি ও ইংরেজি এই চারটি ভাষার পক্ষ-বিপক্ষে নানান মত ছিল।

আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক লিখেছেন, “ভাষা আন্দোলন বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। এর সূচনা মূল আন্দোলন শুরু হওয়ার কয়েক দশক আগেই এবং বাঙালি মুসলমানের সেকুলার জাতিয়তাবোধ এর পেছনে কাজ করেছে।

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট:
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন নিশ্চিত হওয়ার পর উর্দু-বাংলা বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সেসময়কার গুরুত্বপূর্ন ‘মিল্লাত’ পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, “মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে বরণ করার চাইতে বড় দাসত্ব আর কিছু থাকতে পারে না।

ধীরে ধীরে অর্থনীতি ও রাজনীতিও সেই বিতর্কের অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে দৈনিক আজাদি পত্রিকায় লেখক সাংবাদিক আবদুল হক লিখেছিলেন, “উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি উর্দু-শিক্ষিতই চাকুরীর যোগ্যতা লাভ করবেন, এবং প্রত্যেকটি বাংলা ভাষীই চাকুরীর অনুপযুক্ত হয়ে পড়বেন”।

বাংলাভাষীদের আরও উদ্বেগ ছিল দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের মানুষের সাংস্কৃতিক পার্থক্য নিয়ে। শুধু ধর্ম তাদের মধ্যে কতটুকু যোগসূত্র স্থাপন করতে পারবে সেনিয়ে ভাবনা ছিল অনেকের।

অবিশ্বাসের বীজ বপন:
১৯৪৭ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেছিলেন। তখন ভাষা নিয়ে বিতর্ক আবারো জেগে উঠেছিলো। ততদিনে মুসলিম বাঙালীদের আত্ম-অন্বেষণ শুরু হয়ে গিয়েছিলো।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের কয়েক মাসের মধ্যেই পাকিস্তানের প্রথম মুদ্রা, ডাকটিকেট, ট্রেনের টিকেট, পোস্টকার্ড ইত্যাদি থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের এই ঘোষণায় পর ঢাকায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

কমিশনের বাঙালী কর্মকর্তারা সরকারি কাজে বাংলা ভাষার প্রয়োগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছিলেন। পাকিস্তান গঠনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী, পরবর্তীতে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালে আইন পরিষদের অধিবেশনে বলেছিলেন, ভাষা সম্পর্কিত বিতর্ক শুরু হওয়ার আগেই এসব ছাপা হয়ে গেছে। যদিও তার এই বক্তব্য সবাই গ্রহণ করেনি।

রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন:
সেসময় বুদ্ধিজীবীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে মাতৃভাষার পরিবর্তে উর্দু চাপিয়ে দিলে বাংলাভাষী পরবর্তী প্রজন্ম অশিক্ষিত হয়ে পড়বে, বাংলা ভাষার সত্ত্বা ঝুঁকিতে পরবে। স্বাধীনভাবে মাতৃভাষার চর্চার ক্ষেত্রে এটিকে বড় আঘাত বলে মনে করা হয়েছে।

এসব বিষয়ে বাঙালির মনে ক্ষোভের অনুভূতি তখন থেকেই দানা বাঁধতে থাকে। সেই সালেই শেষের দিকে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। সেসময়কার একটি ইসলামি সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের নূরুল হক ভূঁইয়া, তৎকালীন সংসদ সদস্য সামসুল হক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের প্রতিষ্ঠাতা অলি আহাদ, পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ তোয়াহা সহ অনেকেই এর সদস্য ছিলেন যারা শুরুতে গোপনে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন।

জিন্নাহ ও তার অনমনীয় অবস্থান:
তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাংলাভাষীরা উর্দুভাষীদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তারপরও ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক সমাবেশে স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’। সেই সমাবেশেই উপস্থিত অনেকেই সাথে সাথে প্রতিবাদ করে ওঠেন। এই ঘোষণাকে বলা যেতে পারে নতুন রাষ্ট্র সম্পর্কে বাঙালীর স্বপ্নভঙ্গের সূচনা। জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে শুরু থেকে অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ করেছেন।

উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পেছনে বাঙালীদের উপর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভুত্ব কায়েম করা ও শোষণের অভিসন্ধি বলে মনে করা হয়েছিল। বাঙালীদের মনে পাকিস্তানের প্রতি অবিশ্বাসের ভীত তৈরি হয়েছিল।

ভাষা ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য আরও জোরালোভাবে প্রতীয়মান হচ্ছিল। ধর্ম নয় বরং বাঙালী জাতিয়তাবাদের ধারনা স্পষ্ট হতে শুরু করেছিল। অন্যদিকে তখনকার উর্দুভাষীরা বাঙালীর সংস্কৃতিকে ‘হিন্দুয়ানী’ বলে মনে করাটা বাংলা ভাষার প্রতি তাদের বিতৃষ্ণার আরেকটি কারণ।

ভয়ঙ্কর অগ্নি স্ফুলিঙ্গের জন্ম:
জিন্নাহ’র মৃত্যুর পরও রাষ্ট্রভাষা নিয়ে নানা রকম প্রস্তাব, পাল্টা প্রস্তাব চলতে থাকে। দেশভাগের পর থেকে ১৯৫২ সালের শুরু পর্যন্ত বাঙালীরা জোরালোভাবে রাষ্ট্রভাষা উর্দু সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধ মনোভাব ব্যক্ত করে গেছেন।

প্রতিক্রিয়া হিসেবে থেমে থেমে আন্দোলন চলেছে। তবে এই আন্দোলনে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অগ্নি স্ফুলিঙ্গের জন্ম হয় যখন বায়ান্নর ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের অ্যাসেম্বলিতে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়।
পূর্ব-বঙ্গের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় সফরে এসে খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টনে এক সমাবেশে জিন্নাহ’র কথাই পুনরাবৃত্তি করেন। সেসময়ও একইভাবে জোরালো প্রতিবাদে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান ওঠে।
জব্বার এবং শফিউর ছাড়াও আরো অনেকে শহীদ হয়েছিলেন বলে ভাষা আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন বইয়ে উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বীজ বপন:
এই হত্যাকাণ্ড মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়নি। এই আন্দোলনেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মনে এক হওয়ার অনুভূতি সম্ভবত জাগ্রত হবে না।

তবে এই ঘটনার পরও দুই বছরের বেশি সময় পরে, ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান সংসদ বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকার করে প্রস্তাব গ্রহণ করে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি কার্যকর হতে লেগেছিল আরও দুই বছর। মাতৃভাষা নিয়ে এই আন্দোলনেই বীজ বপন হয়েছিল পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের।

আরো দেখুন
Advertisment
বিজ্ঞাপন

সবচেয়ে জনপ্রিয়