সংবাদ১৬.কমঃ যারা শহুরে হাওয়ায় বেড়ে উঠছেন তাদের অনেকে এই শিল্পগুলোর সঙ্গে খুব পরিচিত নয়। কুটির শিল্পের অন্যতম উপাদান বেত বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য বনজ সম্পদ। গ্রামাঞ্চলে অনেকে বসতভিটার আশপাশে বেত লাগায়। আসবাবপত্র তৈরি ও অন্যান্য কুটির শিল্পে বেত ব্যবহার হয়। তরুণ প্রজন্ম জেনে খুশি হবেন একটা সময় ছিল যখন বাংলা থেকে বেত রফতানি হতো। বেত একজাতীয় লতানো বা সোজা বেয়ে ওঠা পাম। এশিয়ার গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের অধিকাংশ বনেই বেত জন্মে। আফ্রিকার আর্দ্র অঞ্চল থেকে ভারত, বাংলাদেশ, দক্ষিণ চীন, ফিজি, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বেত পাওয়া যায়। মালয়েশীয় ভাষায় বেতের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপগোত্রের নাম রতন।
বাংলাদেশ একসময় কুটির শিল্পে সমৃদ্ধ ছিল। বাংলাদেশের জলবায়ু এদেশের মানুষের ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। এদেশের অনেক মানুষ জীবন ধারণ করেন প্রকৃতি প্রদত্ত উপাদানের উপর। প্রকৃতির অন্যতম হচ্ছে বেত ও বাঁশ। যে দুটি উপাদানের ওপর অনেক মানুষ নির্ভরশীল। আমাদের গ্রামে বেশ কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি ছিলেন যারা ভালো বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন রকমের জিনিসপত্র তৈরি করতে পারতেন। এসব জিনিস বানানোর সময় তারা বেতও ব্যবহার করতেন। এই দুটো উপাদানের সঙ্গে আমাদের কুটির শিল্পের সম্পর্ক খুব বেশি। তাই বলতে পারি বাঁশ এবং বেতশিল্প বাংলাদেশের ঐতিহ্যময় কুটির শিল্প। গৃহস্থালিতে বেতের ব্যবহার বহুবিধ। গৃহ নির্মাণে যেমন বেতের প্রয়োজন, তেমনি শৌখিন সজ্জাতেও বেতের কদর রয়েছে। বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকায় পুরুষদের চেয়ে মহিলারা বেতের কাজে বেশি দক্ষ। কিছু কিছু এলাকা আছে যেখানে নারী-পুরুষ সবার জন্য বেতের আসবাবপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরি রোজগারের একটি ভালো উপায় হিসেবে বিবেচিত। বেতের পাশাপাশি বাঁশশিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ লোকশিল্প। এর প্রধান মাধ্যম বাঁশ। সাধারণত গ্রামের লোকেরা এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। মাচা, মই, মাদুর, ঘর, ঝুড়ি, ফাঁদ, বিভিন্ন রকমের হস্তশিল্প ইত্যাদি ছাড়াও মৃতদেহ সৎকার ও দাফনের কাজেও বাঁশ ব্যবহার হয়। নিত্যব্যবহার্য এই বাঁশ এবং বেত সময়ের বিবর্তনে লোকসংস্কৃতি ও কারুশিল্পের প্রধান উপকরণ হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশেও অনেক এলাকায় এই বেত রতন নামেই পরিচিত। বেত গাছে ছোট ছোট এক ধরনের ফল পাওয়া যায়। খুব ছোট বয়সে এই ফলগুলো অনেক খেয়েছি যার স্মৃতি এখনও ম্লান হয়নি।
বিভিন্ন প্রকার বেত পাওয়ার পাশাপাশি প্রায় ২৬ প্রজাতির বাঁশ বাংলাদেশে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে মুলিবাঁশ, তল্লাবাঁশ ও বইরা বাঁশ দিয়ে শিল্পকর্ম করা সহজ।
সাধারণত দুই তিন বছর বয়সের ভালো আকৃতির বেত উন্নতমানের কাজে ব্যবহৃত হয়। মাঝারি পাকা বেতের মধ্যে জলীয় পদার্থ কম ও কাজ করার সময় আঠালোভাব বেশি থাকে। বেশি পাকা বেত কাজ করার সময় ভেঙে যায়। বেতকে প্রক্রিয়াজাত করা না হলে অল্পদিনেই তা বিবর্ণ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের লোকজীবনের খুব কম দিকই আছে যেখানে বাঁশের তৈরি সামগ্রী ব্যবহৃত হয় না। বাঁশের তৈরি মাথাল, ওরা, ভার ইত্যাদি কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়। মাছ ধরার চাঁই, খালুই, জুইতা ইত্যাদি মৎস্যজীবীদের হাতিয়ার। বাঁশের দোচালা, চারচালা ও আটচালা ঘর বাঁশের বেড়া, ঝাপ, বেলকি, দরমা, বর্শা, ঢাল, লাঠি, তীর, ধনুক ও বল্লম হিসেবে বাঁশের বিভিন্ন রকম ব্যবহার লক্ষণীয়। আজও নদীতে পাল তোলা নৌকা দেখা যায়। পাল তোলা নৌকার অন্যতম নির্মাণ উপদান হচ্ছে বাঁশ।
বাঁশির সুর আমাদের মনকে আন্দোলিত করে। সঙ্গীত জগতে বাঁশি না থাকলে আসর জমে না। এদেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে বাঁশের খেলনা ও পুতুল তৈরি করে আসছেন। আসবাপত্র হিসেবে মোড়ার সঙ্গে আমরা দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত। শহরের বিভিন্ন সচেতন মানুষের বাসায় বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র, ছাইদানি, ফুলদানি, প্রসাধনী বাক্স, ছবির ফ্রেম, আয়নার ফ্রেম, কলম দেখা যায়। পান রাখার ঝুড়ি এবং পাহাড়ের উপজাতীয়দের দৈনন্দিন কাজে বাঁশের তৈরি গৃহস্থালি পাত্রসমূহ খুবই আকর্ষণীয়। এসব পাত্র বা ঝুড়িতে বুননের মাধ্যমে নানা ধরনের নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। বাংলাদেশের যে কয়েকটি প্রাকৃতিক উপাদান লোকজীবনের সঙ্গে মিশে আছে তার মধ্যে বাঁশ এবং বেত অন্যতম।
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন অনুসারে বাঁশ ও বেতের কাজ রাঙামাটি অঞ্চলের অন্যতম শিল্প। এখানকার গ্রামীণ জীবনে কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও পারিবারিক কাজে ব্যবহারের জন্য উপজাতীয় পুরুষরা ঘরে বসে নানা সামগ্রী নিজেরাই তৈরি করে। এসব সামগ্রীর মধ্যে কাল্লোং, বারেং, পুল্লেং, ডুল, কুলা, ডুলা, লেই, তলই, সেরি, তেরা চেই, বিজন, খারাং, মারাল্লে, দোলনা, সাম্মো ইত্যাদি অন্যতম। এসব তৈরির জন্য উপকরণ বেত ও বাঁশ বেশ সহজলভ্য। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব সামগ্রী গৃহস্থালির প্রয়োজনে তৈরি করা হতো। অবশ্য বর্তমানে বেতের সাহায্যে মোড়া, সোফা, সেল্ফ ইত্যাদিও তৈরি করা হচ্ছে। বাজারে এসবের চাহিদাও রয়েছে।
বাঁশ ও বেতের সামগ্রী থেকে প্লাস্টিক সামগ্রী কেনার প্রতি এখন আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে। আগে যেভাবে বাঁশ ও বেতের উৎপাদন হতো এখন তার চেয়ে অনেক কমে গেছে। কমে যাওয়ায় এর দামও বেড়ে গেছে। কিছু শৌখিন মানুষের ঘরে বাঙালির ঐতিহ্য প্রদর্শনের জন্য বাঁশ-বেতের সামগ্রী দেখা গেলেও অনেক ব্যবহারকারী বেশি দাম দিয়ে কিনতে চায় না।
নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকে বাঁশ ও বেতের জিনিস বানাতে চায় না। তারা অন্য পেশায় আকৃষ্ট হচ্ছে। বাংলার ঐতিহ্য বাঁশ ও বেতের সামগ্রীকে টিকিয়ে রাখতে হলে এর পেছনের মানুষগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে। প্রয়োজনে বিনা সুদে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় বাঁশ ও বেতের হস্তশিল্প একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বাঁশ ও বেত শিল্পকে বাঁচাতে আমাদের সবার এগিয়ে আসা উচিত। এই শিল্প আমাদের আদিকালের ঐতিহ্য। এটিকে জীবন্ত রাখা আমাদের সবার উচিত।
এই গ্রামীণ লোকজ হস্তশিল্প বাঙালি সংস্কৃতির বড় একটি অংশ। দেশের বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হয় কুলা ঝুড়ি টোপা মাথল চাটাই শরপোস ডালি খলই, চালুন, বেতের কাটা ধামা মোড়া চেয়ার। বিসিক একটি নকশা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এই কেন্দ্রের শিল্পীরা বেতের শিল্পকর্মে নতুন নকশা ও নমুনা উদ্ভাবন করার গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন। এই শিল্পে নিয়োজিত কারুশিল্পীদের সহায়তা করার জন্য নকশা কেন্দ্র বিনামূল্যে তাদের মধ্যে নতুন উদ্ভাবিত নকশা বা নমুনা বিতরণ করে থাকে। বিসিক লোকজ শিল্পের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার চেষ্টা করছেন। বিসিক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কারুপল্লী খুঁজে বের করেছে এবং কারুশিল্পের উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদান করছে। বিসিকের সূত্র মতে, ২৯টি নির্বাচিত কারুপণ্যের সর্বমোট ৪,২২৬টি কারুপল্লীর মধ্যে বাঁশ ও বেতের জিনিসের কারুপল্লীর সংখ্যা ১,১৫৪টি।
এশিয়া ও ইউরোপে বেতের তৈরি সামগ্রীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ বেতের তৈরি বিভিন্ন ধরনের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সামগ্রী রাশিয়া, জার্মানি, সিঙ্গাপুর এবং মধ্যপ্রাচ্যে রফতানি করে থাকে। জানা গেছে, ১৯৯৯-২০০০ সালে বাংলাদেশ বেত ও বাঁশজাত পণ্য রফতানি করে ২৫ কোটি ৮৬ লাখ টাকা অর্জন করেছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে হ্যান্ডিক্রাফটস রফতানির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ ডলার। আর পুরো বছরে রফতানি হয় ১ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে রফতানি হয়েছে ১ কোটি ৭১ লাখ ডলারের হ্যান্ডিক্রাফটস পণ্য। ফলে দশ মাসেই উচ্চ প্রবৃদ্ধি এসেছে এ খাত থেকে।
সম্প্রতি বন বিভাগ প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম বনে বেত চাষ শুরু করেছে। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে এই উপজেলায় বাঁশ ও বেত শিল্পের তৈরি মনকাড়া বিভিন্ন জিনিসের জায়গা দখল করেছে স্বল্প দামের প্লাস্টিক ও লোহার তৈরি পণ্য। তাই বাঁশ ও বেতের তৈরি মনকাড়া সেই পণ্যগুলো এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে। অভাবের তাড়নায় এই শিল্পের কারিগররা দীর্ঘদিনের বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে অন্য পেশার দিকে ছুটছে। তবে শত অভাব অনটনের মধ্যেও হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার আজও পৈতৃক এই পেশাটি ধরে রেখেছে। সরকারের সহায়তা পেলে এই লোকজ শিল্পগুলোর আবার সমৃদ্ধি আসবে। আমি সরকারকে অনুরোধ জানাব এই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুগোপযোগী করা হোক। প্রতিবছর পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বাঁশ ও বেতের জিনিসপত্র যেন প্রদর্শন করা যায় তার বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হবে।
গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ পরিচিত। আদিবাসীদের জীবনাচরণ ও অনুভূতির সঙ্গে বেত ও বাঁশের সম্পর্ক অনেক প্রাচীন। আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে বাঁশের তৈরি শিল্পকর্ম দীর্ঘস্থায়ী না হলেও ব্যক্তি জীবনে বহুমাত্রিক প্রয়োজনের কারণে এই শিল্পকর্ম বংশপরম্পরায় চলে আসছে। ভিন্ন ভিন্ন কাজে ভিন্ন ধরনের বেত ব্যবহার করা হয়। বুনন ও বাঁধানোর কাজে বেত ব্যবহৃত হয়। নকশার ধরন বুঝে সরু ও মোটা বেতের বিভিন্ন ধরনের অংশ তুলে নিতে হয়। জালি বেত দিয়ে চেয়ার, টেবিল, দোলনা, বাস্কেট, মহিলাদের ব্যাগ ও বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী তৈরি হয়। গোল্লা বেত দিয়ে নিত্যব্যবহার্য আসবাবপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী তৈরি করা হয়।