বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪
spot_img

ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতার পাতায় পাতায় ভুলে ভরা পাঠ্য বই

সংবাদ১৬.কমঃ চলতি বছরের নতুন বইয়ের কয়েকটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শুধু অষ্টম ও নবম-দশম শ্রেণির বইয়ে ৩০টির অধিক ভুল রয়েছে। নবম-দশম শ্রেণির বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা বইয়ে বলা হয়, ১২ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের নিকট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন।

বইটির ২০০ নম্বর পৃষ্ঠায় ছাপানো এ তথ্যে রয়েছে ভুল। সঠিক তথ্য হলো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে শপথ পড়িয়েছেন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। একই বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ২৬শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ জুড়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নির্যাতন, গণহত্যা আর ধ্বংসলীলায় মেতে ওঠে। সঠিক তথ্য হলো- পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্যাতন, গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা শুরু হয় ২৫শে মার্চ কালরাতে। এই বইয়েই সংবিধানের আলোচনায় বলা হয়েছে, পঞ্চম ভাগে জাতীয় সংসদ। সঠিক তথ্য, পঞ্চম ভাগে আইনসভা। একই শ্রেণির আরেক বইয়ে, পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প, পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আক্রমণ চালায় ও নৃশংসভাবে গণহত্যা ঘটায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বইয়ের ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় এমন তথ্য দেয়া হয়। যদিও রাজারবাগ ছিল পুলিশ লাইন্স। আর পিলখানায় ছিল ইপিআর সদর দপ্তর। অষ্টম শ্রেণির “বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়” বইয়েও রয়েছে বেশ অসঙ্গতি। এ বইয়ে দেশের ভয়াবহ বন্যার সালগুলো উল্লেখ থাকলেও ১৯৮৭, ২০০০, ২০০৭ ও ২০১৭ সালের বন্যার খবর নেই।

এছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ে অনেক ভুল রয়েছে। এছাড়াও বানান ও যতি চিহ্নের ভুল রয়েছে অধিকাংশ বইয়ে। আছে ব্যাকরণগত ভুলও। এদিকে পাঠ্যবইয়ে এসব ভুল নিয়ে সমালোচনা চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রকাশ্যেই অনেকে সমালোচনা করছেন এসব ভুলের।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এক স্ট্যাটাস দিয়ে ক্ষোভ জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর মো. মিজানুর রহমান। তিনি লেখেন, বখতিয়ার খলজী অসংখ্য বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংস করেছেন, এরকম অনেক অনৈতিহাসিক, অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েই লিখা হয়েছে এবারের স্কুলের পাঠ্যবই। কোনো নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সোর্সই এ ধরনের বক্তব্যের সত্যতা প্রতিপাদন করে না। মনে হয়েছে, ইতিহাস নয় বরং লেখকদের কারো কারো নিজস্ব বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে বইয়ের পাতায় পাতায়। পাক-ভারত-বাংলাদেশ এক সময় ছিল বৌদ্ধ অধ্যুষিত। সেই বৌদ্ধরা কীভাবে এদেশ থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়ে গেল তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে তবে তার কোনোটাতেই বখতিয়ার খলজীকে অনেকগুলো বিহার ও লাইব্রেরি ধ্বংসের জন্য দায়ী করা হয় নাই। এনসিটিবিটি কীসের উপর ভিত্তি করে লেখক আর কন্টেন্ট নির্ধারণ করে বুঝতে পারলাম না।

গত ১ জানুয়ারি সারা দেশে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দিয়েছে সরকার। কিন্তু সব শিক্ষার্থী এ বই পায়নি। যারা পেয়েছে তারাও সব বই পায়নি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বিভিন্ন সংকটের কারণে যথাসময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই দিতে পারেনি বললেও খোলা বাজারে সহজেই মিলছে নতুন বই। এসব বই চড়া দামে বিক্রি করছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের হাতে যেসব নতুন বই তুলে দেয়া হয়েছে সেসব বইও ভুলে ভরা। ইতিহাস থেকে শুরু করে তথ্য ও পরিসংখ্যানগত ভুল রয়েছে এসব বইয়ে। আছে বানান ও যতি চিহ্নের ভুলও। পাঠ্যপুস্তকে এমন ভুল নিয়ে চলছে সমালোচনা। ইতিমধ্যে পাঠ্যবইয়ের ভুল ধরার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে এনসিটিবি।
নতুন বইয়ে যে ভুল রয়েছে সেগুলো আগামী বছরগুলোতে সংস্কার করা হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। আর শিক্ষাবিদরা বলছেন, এ ধরনের ভুল কাম্য নয়। সংশ্লিষ্টদের এসব বিষয়ে আরও সতর্ক থাকতে হবে। গত বছরও পাঠ্যবইয়ে ভুলের জন্য এনসিটিবি চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কড়া সমালোচনা করেন হাইকোর্ট।

প্রতি বছরই শুরুতে শিক্ষার্থীরা বই না পেলেও খোলাবাজারে মেলে এনসিটিবি’র বই। তারপরও নতুন বইয়ে ভুল ও কালোবাজারি বন্ধে যথেষ্ট উদ্যোগী নয় এনসিটিবি। গতকাল রাজধানীর নীলক্ষেতের বিভিন্ন লাইব্রেরি ও ফুটপাতের বইয়ের দোকানে নতুন বই আছে কি না খোঁজ নেয়া হয়। যেখানে অনেকে নতুন বই আছে বলে জানান। সরজমিনে দেখা যায়, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের সব শ্রেণিরই নতুন বই পাওয়া যাচ্ছে এসব দোকানে। দর কষাকষিও করা যাচ্ছে। ফুটপাথের একটি দোকানে নবম-দশম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণের মূল্য চাওয়া হয়েছে ১৮০ টাকা। আর দ্বিতীয় শ্রেণির ইংরেজি ও গণিত বইয়ের দাম চাওয়া হয় ২৫০ টাকা।

বিক্রেতারা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাওয়া না গেলেও আমাদের কাছে সব শ্রেণির বই-ই পাওয়া যায়। কোনোটি না থাকলে ম্যানেজ করে দেয়া যাবে। কিন্তু কোথা থেকে এসব বই হাতে আসছে তা জানাতে অস্বীকৃতি জানায় তারা। শিক্ষার্থীরা না পেলেও খোলাবাজারে প্রকাশ্যে বই বিক্রি হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।

আবুল হোসেন নামে এক অভিভাবক বলেন, আমাদের ছেলে-মেয়েরা যথা সময়ে নতুন বই পায় না। অথচ খোলাবাজারে নতুন বই পাওয়া যায়, বিষয়টি দুঃখজনক। এনসিটিবি’র কর্মকর্তারাই এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত বলে অভিযোগ এ অভিভাবকের।

নতুন বইয়ের বিষয়ে মাগুরার শালিখা উপজেলার শিক্ষা অফিসার আকবর হোসেন জানান, তারা প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শতভাগ বই পেলেও তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কেবল দু’টি করে বই পেয়েছেন। এছাড়া পাঠ্যবইয়ে ভুলের কোনো সংশোধনী তারা পাননি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুল জলিলও জানান, তারা এ পর্যন্ত ৬৭-৬৮ শতাংশ বই পেয়েছেন। আর ভুলের কোনো সংশোধনী এখনো হাতে পাননি। পাঠ্যবইয়ে ভুলের বিষয়ে এনসিটিবি কর্মকর্তারা জানান, পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় পাঠ্যবইয়ে কিছু কিছু ভুল থেকে যাচ্ছে। এছাড়া প্রতিটি বই প্রেসে দেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের দেয়া হয়। তারা চূড়ান্ত করার পরই বই প্রেসে দেয়া হয়। কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের চোখে ভুলগুলো ধরা না পড়লে এনসিটিবি’র কিছু করার থাকে না। তাই এসব ভুল নিয়ে পরবর্তীতে আবার কাজ করতে হয়।

পাঠ্যবইয়ে ভুলের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ড. মো. আব্দুস সালাম বলেন, বিনামূল্যে বই একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। পৃথিবীর আর কোথায়ও এমন আছে কি না আমার মনে হয় না। সরকারের পরিকল্পনা চমৎকার। কিন্তু পাঠ্যবইয়ে ভুল তথ্যের বিষয়টি দুঃখজনক। সংশ্লিষ্টদের আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল। পরবর্তীতে হয়তো সংশোধন হবে কিন্তু যে ভুল হয়ে গেছে সেটিরতো একটি প্রভাব রয়েছে। পাঠ্যবইয়ে ভুলের বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর ফরহাদুল ইসলাম বলেন, আমরা ভুলগুলো দেখছি। কারেকশন করছি।

পাঠ্যবইয়ে ভুলের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, এবার ষষ্ঠ, সপ্তম ও প্রথম শ্রেণিতে যে বইগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে উঠেছে সেগুলোতে ভুল থাকতে পারে। কারণ বইগুলো নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে। বইগুলোতে যে সব ভুল পাওয়া যাবে সেগুলো আগামী বছরগুলোতে সংস্কার করবো। ভুলের তথ্য পাওয়া গেলে তা জানাতে বলেছেন দীপু মনি। মানবজমিন

আরো দেখুন
Advertisment
বিজ্ঞাপন

সবচেয়ে জনপ্রিয়